সেসময় এখনকার মতো বারোয়ারিতলায় দুর্গাপুজোর ফেলে যাওয়া মণ্ডপে লক্ষ্মীপুজোর চল ছিল না| মা লক্ষ্মী ছিলেন অন্দরের দেবী| তাঁর অধিষ্ঠান ছিল গৃহস্থের ঠাকুরঘরে| দশমীর ভাসানের পরে পূর্ণিমা তিথি আসার আগেই কুলুঙ্গিতে থেকে নামিয়ে আনা হত বেতের লক্ষ্মীর ঝাঁপি— তাতে রাখা লাল শালু মোড়া সিঁদুরকৌটো, কয়েকটা ক্ষয়াটে সাদা কড়ি, কাঁচা টাকা, ইঁদুরের ফেলে রেখে যাওয়া গতপুজোর ধানছড়ার অবশিষ্টাংশ|এগুলোই ছিল সাধারণ পরিবারের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সম্পদের প্রতীক| সম্পন্ম পরিবারে অবশ্য বেতের জায়গায় রুপোর কুনকেতে থাকত গিনি| যার ঘরে যা-ই থাকুক, আশ্বিনের শুক্লপক্ষের ‘পৌর্ণমাসি’ তিথিতে অর্থাৎ পূর্ণিমায় ধনী-দরিদ্র সকলের ঘরে ঘরে আয়োজন করা হত কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর| কারও বাড়িতে আমশাখা আর ধানের ছড়া রাখা স্বস্তিক আঁকা ঘটেই লক্ষ্মীর পুজো সারা হত| সরার ওপর আঁকা লক্ষ্মীর পটে কোজাগরী পুজোটা মূলত পূর্ববঙ্গীয়দের মধ্যে প্রচলিত ছিল|
আমার দিদিমার বাড়ি ছিল ফরিদপুরে| বিবাহসূত্রে তিনি মেদিনীপুরের একান্নবর্তী পরিবারের বধূ হয়ে এসেছিলেন| তবে দুর্গাপুজোর পরে সেই বাড়িতে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোই হত পূর্ববঙ্গীয় রীতি মেনে| বিজয়া দশমী করতে বাবা-মায়ের সঙ্গে গ্রামের মামাবাড়িতে এসে লক্ষ্মীপুজো কাটিয়েই ফিরতাম বাবার কমর্স্থল কলকাতায়| লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন থেকেই দেখতাম সদর দরজা থেকে ঘরের উঠোন, দরজার চৌকাঠ, সিঁড়ি, দোতলায় ঠাকুরঘরের লাল সিমেন্টের মেঝেতে ফুটে ওঠা সারি সারি সাদা রঙের ইংরেজি ‘এস’ অক্ষর, মাথায় পাঁচ ফোঁটা লাগানো| ওই নাকি মা লক্ষ্মীর চরণচিহ্ন| সদর থেকে অন্দরের দিকে| মা সরু সরু আঙুল পিঠুলি গোলার বাটিতে ডুবিয়ে নিমেষে এঁকে ফেলত যে আশ্চর্য চিহ্ন, লক্ষ্মীপদ| প্রথমে অস্বচ্ছ জলের মতো সেই আলপনা শুকোলেই কেমন করে উজ্জ্বল হয়ে উঠতো, তা আমার কাছে ছিল এক বিস্ময়| তখনও সরায় আঁকা পটচিত্র দেখে লক্ষ্মীর আসল রূপটা বোধগম্য হয়নি| তবে সেই অবোধবেলায় ওই লক্ষীপদের পাশে নিজের পায়ের মাপ নিয়ে দেখেছি – প্রায় সমান সমান| সেই থেকে মা লক্ষ্মীকে নিজের সমবয়সী একটা মেয়েই ঠাওরেছিলাম| বিশেষ করে আমায় যখন সবাই লক্ষ্মী মেয়ে বলেই প্রশংসা করত!
এমন একটা মেয়ের পুজো নিয়ে সবাই যখন ব্যস্ত হয়ে পড়ত, বিশেষ করে মা, দিদিমা, আলতামাসি, রান্নাপিসি তখন কেন জানি না মজা লাগত| দেখতাম অন্য পুজোতে বাড়ির ছেলেদের হম্বিতম্বিটা কেমন কমে যেত| আমার রাশভারী বাবাকে দেখতাম, ফর্দ মিলিয়ে পুজোর বাজারহাট করে এনে মায়ের সামনে কাচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে| অত ছোট বয়সে ‘জেন্ডার কনসেপ্ট’ তৈরি হয় না| তবুও লক্ষ্মীপুজোটা যে মেয়েদের নিজস্ব একটা তোড়জোড়ের জায়গা, আমারই মতো ছোট একটা মেয়ের পুজো পাওয়ার বিষয় সেটা ভেবেই খুব মজা হত| হয়তো শৈশবের সেই কোজাগরী পুজো থেকেই আমার অবচেতনেই ‘ফিমেল ডমিনিজম’-এর বোধটা অংকুরিত হয়ে গিয়েছিল| যা ফুটতে থাকল ক্রমশ|
এরপর বাড়িতে এলেন বড়মামিমা| দুধে আলতা গায়ের রং, টানা টানা চোখ, টিকালো নাক, গা ভর্তি গয়না, কাছে গেলে কী মিষ্টি গন্ধ নাকে আসে| সবাই বলতে লাগল একেবারে সাক্ষাৎ লক্ষ্মী প্রতিমা| এরকমই তাহলে দেখতে হয লক্ষ্মী ঠাকুরকে| কিন্তু সরায় আঁকা লক্ষ্মীঠাকুরের পেঁচাটা কোথায়? তাকে কোথায় ফেলে এল?
প্রশ্নার উত্তর পেতে আরও কিছুটা সময় লাগল| তখন একটু উঁচু ক্লাসে উঠেছি| লক্ষ্মীপুজোর সময় দাদু উদাত্ত গলায় যে মন্ত্রগুলো উচ্চারণ করতেন, তার মানে একটু একটু করে বুঝতে চেষ্টা করছি| খটকা লাগলে দাদুকে প্রশ্ন করেছি| সেখান থেকেই শুনেছি লক্ষ্মী দেবীর বাহন সবসময় প্যাঁচাই যে ছিল, তা নয়| হাতি, ময়ুর, হরিণকেও লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে দেখা গিয়েছে| ঋকবেদের খিলসুক্ততে (পরিশিষ্ট) লক্ষ্মীর ‘হিরণ্যবরণাং হরিণী সুবর্ণা’ প্রতিপ্রভা রূপের বর্ণনা রযেছে| প্রাচীন রাজারা যে মুদ্রা ছাপতেন, সেখানেও লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে হরিণকে দেখা গিয়েছে| কাজেই বাহন পছন্দের বিষয়েও লক্ষ্মী যে স্বভাব চঞ্চলা, এ বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল|
তবে খটকা লাগল লক্ষ্মীর ‘শ্রী’ নিয়ে| আসলে তখন তো ওই এখনকার মতো ‘কন্যাশ্রী’, ‘রূপশ্রী’ প্রকল্পগুলোও ছিল না| তাই ওই ‘শ্রী’ ব্যাপারটা যে কী, তা পরিষ্কার করতে বিস্তর পৌরাণিক কাহিনি শুনতে হল| ‘শ্রী’ –এর অর্থ সৌন্দর্য, সমৃদ্ধি, সৌভাগ্য এমনকী নারীশক্তিও| তখন থেকেই মনে হতে লাগল লক্ষ্মী যত না দেবী, তার থেকেও বেশি মিথ বা একটা কনসেপ্ট|একজন নারীর স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধ্রুবক এই ‘শ্রী’|সত্যি বলতে কী লক্ষ্মীর দেবী হিসেবে গোত্রভুক্ত করা হয়নি ঋকবেদের দশমণ্ডল সূত্রতে (মন্ত্রের সমষ্টি)| পরে ঋকবেদের পরিশিষ্টতে তাঁকে ‘শ্রী’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে| ধনের দেবী হিসেবে তাঁর অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়েছে| তবে শুধু ঋকবেদ কেন, গ্রিসের ধনদাত্রী দেবীকে বলা হত ‘ঈলীনা’| লৌকিক দেবীর মহিমা রয়েছে ধনদাত্রী দেবী লক্ষ্মীর|
অন্যদিকে পুরাণকথায় লক্ষ্মীর সম্পর্ক দেবদেবীর সঙ্গে| বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবত পুরাণে কথিত আছে, একবার ঋষি দুর্বাসার আশ্রমে ইন্দ্র উপস্থিত হলে ঋষির আদেশে বনদেবী এক অপরূপ মালা তৈরি করে তা উপহার দিলেন দেবরাজ ইন্দ্রকে| ইন্দ্র তা হেলাভরে ঐরাবতের শুঁড়ে পরিয়ে দিলেন| সেই মালার গন্ধে আকুল হয়ে ঐরাবত সেই মালা মাটিতে ফেলে দিলে দুর্বাসা ইন্দ্রকে অভিশাপ দিলেন, তোমার স্বর্গ থেকে লক্ষ্মী বিদায় নেবে| শ্রীহীন হয়ে পড়বে স্বর্গ| দুর্বাসার অভিশাপের জেরেই স্বর্গ থেকে নির্বাসিত হলেন দেবী লক্ষ্মী, তিনি কন্যারূপে আশ্রয় নিলেন সমুদ্রে| দিনে দিনে স্বর্গ হতশ্রী হয়ে পড়তে লাগল| অসুরেরা দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের পরাস্ত করে স্বর্গের দখল নিলেন এবং অমৃতের অধিকারী হয়ে অমরত্ব পেতে চাইলেন| তখন দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন|বিষ্ণু পরামর্শ দিলেন, দেবতারা অসুরদের সঙ্গে কূটনৈতিক সন্ধি করুক| সেই সন্ধিতে ঠিক হল সমুদ্র মন্থনের মাধ্যমে অমৃতের সন্ধান করা হবে| এবং তা দেবতা এবং অসুরদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়া হবে| এই সময় বিষ্ণু দেবতাদের আশ্বস্ত করলেন, তিনি এমন উপায় করবেন, যাতে ওই অমৃত শুধু দেবতারাই পান|যথাকালে মন্দার পর্বতকে মন্থন দণ্ড এবং বাসুকীকে মন্থনরজ্জু হিসেবে ব্যবহার করে সমুদ্র মস্থন চলতে লাগল| বিষ্ণু নিজে কূর্ম অবতারের রূপ ধারণ করে নিজের পিঠ দিয়ে মন্দারপর্বতকে দৃঢ়তা দিলেন| এরপরের গল্প সকলেরই জানা| সমুদ্র থেকে নানা দেবী,অপ্সরী, পশু, নানান ভেষজ, রত্নরাজি উঠে আসতে লাগল| কৃষ্ণের মায়াতেই অমৃতসহ উত্তম উপহারগুলি পেলেন দেবতারা|অসুররা অমৃতের অধিকারী হতে পারলেন না| সমুদ্র মন্থনে প্রথমেই উঠে এলেন দেবী লক্ষ্মী,যিনি সৌভাগ্য ও ঐশ্বর্যের দেবী| যিনি যিনি নিজ ইচ্ছামতে বিষ্ণুকে নিজের স্বামী হিসেবে বরণ করলেন| বলা চলে স্বয়ম্বরা হলেন| লক্ষ্মীদেবীর পুজোর মন্ত্রেও সেকথার উল্লেখ রয়েছে| ‘বন্দে বিষ্ণুপ্রিয়াং দেবীং, দারিদ্র্য দুঃখনাশিনীঃ| ক্ষীরোদ সম্ভবাং দেবীং বিষ্ণুবক্ষ বিলাসিনীঃ’|
স্কুলে তখন উঁচুর দিকের ক্লাসেই পড়ি|কাজেই পুরাণের মধ্যে সত্যতা বা কল্পনা যা-ই থাক না কেন, মা লক্ষ্মীর এই স্বাধীনচেতা, শক্তিস্বরূপিণী এবং সেইসঙ্গে সমৃদ্ধিশালিনী ইমেজটায় আকৃ্ষ্টই হয়ে পড়েছিলাম| কিন্ত গোল পাকালো ওই লক্ষ্মীর পাঁচালী| প্রতি বৃহস্পতিবার মায়ের সুর করা গলাতে পড়া – ‘দোল পূর্ণিমার নিশি, নির্মল আকাশ,/মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস’ দিয়ে আরম্ভ করে লক্ষ্মীর পাঁচালীর পরবর্তী কথাগুলো নারীর ‘অর্ধেক আকাশ’কে একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দিল|
সেই লক্ষ্মীর পাঁচালীর ছত্রে ছত্রে নিদান রয়েছে, সংসারকে সুখী করার জন্য মহিলাদের একতরফা কৃচ্ছসাধনের| পুরুষের ক্ষেত্রে লক্ষ্মীর আশীর্বাদ পেতে শুধু উদ্যমী হলেই হবে|‘উদ্যোগিণো পুরুষসিংহেণমুপৈতি লক্ষ্মীঃ’|আর নারীর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে লক্ষ্মীপুজোর সব আয়োজন শেষে অতিথি ভোজন, স্বামী ভোজনের পরে যদি কিছু উদ্বৃত্ত থাকে, তবেই মহিলারা তা গ্রহণ করবেন| সংসারকে সুখী করে তোলার জন্য বাড়ির মেয়েদেরই সুলক্ষণা হতে হবে, বাড়ির আচার নিয়ম নিষ্ঠাভরে পালন করতে হবে| পাচকের হাতে নয়, নিজের হাতে রান্না করতে হবে, শ্বশুর-শাশুড়িকে সঙ্গে নিয়ে থাকতে হবে| এমনকী মেয়েদের শাখা-পলা- উজ্জ্বল সীমন্তিনী হয়ে থাকার বিষয়েও ফরমান জারি করা হয়েছে লক্ষ্মীর পাঁচালীতে| শুধু কী তাই? আত্মপ্রচার করার জন্য লক্ষ্মীর পাঁচালীতে বর্ণিত অবন্তীনগরের সওদাগরের নৌকো ডোবানোর যে গল্প ফাঁদা হয়েছে, যেখানে লক্ষ্মীপুজোকে অবহেলায় সওদাগরের নৌকো ডোবে, আবার ভুল বুঝে লক্ষ্মীকে অর্চনা করলে ফের সেই সওদাগর সব ধন সম্পত্তি ফিরে পায়| সত্যি বলতে কী, এই ধরনের গল্পকে লক্ষ্মীর পাঁচালীতে স্থান দিয়ে পাঁচালীকাররা শুধু সওদাগরের নৌকোটিকেই নয়, শাস্ত্র ও পুরাণ শুনে লক্ষ্মীদেবীর যে কল্যাণময়ী ইমেজটি আবাল্য থেকে তৈরি হয়েছিল, তারও ভরাডুবি হয়ে গেল|
লক্ষ্মীর অংশে জন্ম নেওয়া মেয়েদের জন্য যে জীবনচর্চার বিধান সেই সময়কার পাঁচালীকাররা রচনা করেছিলেন, তা আসলে সেই সময়কার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর অবস্থান| যে বিধানের শেকল থেকে মেয়েরা বহুদিন নিজেদের মুক্ত করেছে| পাঁচালীকাররাই পৌরাণিক দেবী লক্ষ্মীকে থেকে নিজের পছন্দমতো লোকাচারের বিধান দিয়ে লৌকিক দেবী বানিয়ে তুলেছিলেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে| আর একটু বড় হতেই সেটা বোঝার বয়স যখন হল, ওই কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে দুব্বো হাতে লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়বার সময়টায় নিঃশব্দে গা ঢাকা দিতাম| মায়ের বকুনি সত্ত্বেও| যদিও লক্ষ্মীপুজোর ভোগের খিঁচুড়ি, পায়েসের প্রসাদ থেকে কোনওভাবেই বঞ্চিত হতাম না| ভালো লাগতে সারারাত জেগে থাকতে|
তবে একটু বড় হতে বুঝলাম এই কোজাগরী পুজোয় জ্যোৎস্নার বানভাসিতে অনেক লুকনো আনাচ কানাচ স্পষ্ট হয়ে ওঠে| চোখের জলে লাগে জোয়ার| কানায় কানায় হয কানাকানি| এমন ভাবনাটা এসেছিল আমার ছোটমামাকে দেখে| আর্ট কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর করা আমার ছোটমামার ওপর দায়িত্ব থাকত আলপনা দেওয়ার| ছোটমামার ছবি নিয়ে শহরের নামী প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনী হত| এসবের পরেও ছোটমামাকে দেখেছি মামাবাড়ির কালো বর্ডার দেওয়া লাল সিমেন্টের মেঝেতে খুব যত্ন করে আলপনা দিতে| সূর্য, ধানের শিষ, পেঁচা, মই, লাঙল,মাছ,পানপাতা ফুটিয়ে তুলতে| খুব মনোযোগ দিয়ে পদ্মলতায় টান দিতে, ঘরময় লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আঁকতে|অথচ এই কোজাগরীর দিনটা ছাড়া তো অন্যসময় কোনওিদন আলপনার টান পড়ে না ছোটমামার হাতে!
ছোটমামা ধরিয়ে দিল আমাদের ভুলটা| বলল, তাজমহলের মিনাকারির কাজ, মোঘল মিনিয়েচার, মধুবনী পেন্টিং, জয়পুরের আর্ট কখনও খুঁটিয়ে দেখেছিস? দেখবি ওর মধ্যেও আমাদের এই বেসিক আলপনা আর্টের কোনও না কোনও খণ্ডাংশ রয়ে গিয়েছে| এই লৌকিক ধর্মীয় আলপনার নকশারীতি কোনও না কোনওভাবে জারিত হয়ে আন্তর্জাতিকতায়| ছোটমামাই সেদিন দৃষ্টিতে সূক্ষ্মতা এনে দিয়েছিল| আমার ছোটমামা কেন অবিবাহিত, সেকথা জিজ্ঞেস করতে সাহস পায়নি কখনও|মায়ের কাছে শুনেছিলাম লক্ষ্মীর পদচিহ্ন গৃহস্থের ঘরে ধনাগমের প্রতীক| কিন্তু সেদিন যখন ছোটমামা লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আঁকছিল আমার কেন জানি না মনে হচ্ছিল, এ আলপনা হয়তো ছোটমামার স্মৃতির উঠোনে কারও আসার জন্য আজীবন পথ চেয়ে থাকার আলিম্পন!শুধু ‘ঘরেতে এলো না সে তো, মনে তার নিত্য আসা যাওয়া’| ছোটমামার জীবনেও ওই লক্ষ্মীপদের আলপনার ছাপ শত বৃষ্টিজলেও ধুয়ে যায়নি|
তখন আমি কলেজে পা রেখেছি| মনের মধ্যে প্রেম পাপড়ি মেলতে শুরু করেছে| তবে সব প্রেম বোধহয় গোলাপের মতো ফোটে না| কখনও কখনও মনে হয় পূজা মূর্তি ধরি প্রেম দেখা দিল দুঃখের আলোকে| সেইসব প্রেম পাপড়ি মেলে আঁধার রাতের শেষে ফোটা পদ্মের মতো, তার গায়ে লেগে থাকে পুজোর গন্ধ| সেই পদ্মের কোরক ভ্রমরের ওষ্ঠস্পর্শেও উচ্ছিষ্ট হয় না| বরং সে পদ্মমধুতেই ভরে ওঠে মধুপর্কের বাটি| একবার কোজাগরীর পুজোর দিনে ছোটমামা তার চিলেকোঠার ঘর থেকে আর নীচে নামতে পারল না| আমি দেখা করতে গেলাম, দেখলাম জীবনানন্দ পড়ছে| আমাকে শুনিয়ে দিল কোজাগরী নিয়ে জীবনানন্দের কবিতা—
“মনে হয় একদিন আকাশে শুকতারা দেখিব না আর,
দেখিব না হেলেঞ্চার ঝোপ থেকে একঝাড় জোনাকি কখন
নিভে যায়—দেখিব না আর আমি এই পরিচিত বাঁশবন,
শুকনো বাঁশের পাতা-ছাওয়া মাটি হয়ে যাবে গভীর আঁধার
আমার চোখের কাছে- লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে সে কবে আবার
পেঁচা ডাকে জোছনায় – হিজলের বাঁকা ডাল করে গুঞ্জরণ,
সারা রত কিশোরীর লাল পাড় চাঁদে ভাসে-হাতের কাঁকন
বেজে ওঠে, বুঝিব না- গঙ্গাজল,নারকেল নাড়ুগুলো তার
জানি না সে কারে দেবে- জানি না চিনি আর সাদা তালশাঁস
হাতে লয়ে পলাশের দিকে চেয়ে দুয়ারে দাঁড়ায়ে রবে কি না
আবার কাহার সাথে ভালোবাসা হবে তার- আমি তা জানি না,
মৃত্যুরে কে মনে রাখে?…”
কিছুদিন পরেই দুঃসংবাদটা পেয়েছিলাম, ছোটমামা আর নেই| তারপর থেকে লক্ষ্মীপুজোটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল| আমাদের গ্রামের মামাবাড়িতে| ততদিনে নিজেও একটা চাকরিতে ঢুকেছি| বুঝেছি মামারবাড়ির কুলুঙ্গিতে রাখা সেই লক্ষ্মীর ঝাঁপির আসল রহস্যটা| লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নয়, লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে রাখতে হয় নিজেরই স়ঞ্চয়| কারণ লক্ষ্মী স্বভাবে চঞ্চলা, কাজেই স়ঞ্চয়ী না হয়ে ওড়াতে শুরু করলে বাহন পেঁচার পিঠে চেপে লক্ষ্মী উড়ে যাবে ফুরুত করে| স্কুলে একবার লক্ষ্মীর পরীক্ষা নাটকে রানির পরিচারিকা ‘ক্ষীরো’র চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম| আজও ভুলিনি ক্ষীরোর সংলাপটা–
“হে মা লক্ষ্মীটি, তোমার বাহন পেঁচা পক্ষীটি, কথনও যদি সে আমার পানে, তোমারে যদি সে বহিয়া আনে, সোনা দিয়ে ডানা বাঁধাই, তবে ওড়বার পথ বন্ধ হবে|” বুঝেছি মা লক্ষ্মীকে অচলা করে রাখতে গেলে সঞ্চয়ের অংকটা কীভাবে কষতে হবে|
কিন্তু এত কিছুর মধ্যে জীবন কি বেহিসেবি হয় না? হয় তো| জমার ঘরে কী থাকবে না ভেবেই খরচ করে ফেলতে হয় কিছুটা সময়, কিছু অনুভূতি| প্রতিদানে রয়ে যায়, কিছু স্মৃতি| সেই স্মৃতি থেকেই না হয় শোনা যাক, আমার এক প্রিয় মানুষের বলা কবিতা| সেও এক কোজাগরীর দিনে, পুরুলিয়ায় এক অরণ্যে, নিশিযাপনে|
ভালোবাসা মানে কোজাগরীর চাঁদ-
জোছনায় পা ডুবিয়ে
সারারাত বসে থাকা অরণ্য বাংলোয়|
নাম-না জানা কে জানে কার
আকুল ডাক!
এতটুকু শুনেই সেদিন কী আকুল শিহরণ খেলে গিয়েছিল গায়ে!আজও কোজাগরী পূর্ণিমায় চাঁদের দিকে ডানা মেলা সেই পাখিকে খুঁজি| কোজাগরীর চাঁদের গায়ে বিষাদের কালো রেখাটাকে খুঁজি| বানভাসি জ্যোৎস্নায় ছোটমামার গলায় জীবনানন্দকে খুঁজি| ঘরের মেঝেতে খুঁজি মায়ের হাতের পদ্মলতার আলপনার টান, দিদিমার রাঁধা ভোগের সুঘ্রাণ| ফেলে আসা কত কিছুই যে খুঁজি!
আসলে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো যে আমাদের এক শারদ উৎসবের উপসংহারের মতো আসে| দুর্গাপুজোর ফেলে যাওয়া প্যান্ডেলে, আধখোলা মোটিফ দিয়ে সাজানো আসরে, টিমটিম আলোয় অধিষ্ঠাত্রী হল মা লক্ষ্মী| শেষ গানেরই রেশ নিয়ে| সেদিন ছিল দেবী পক্ষের শেষ বেলা| কোজাগরীর চাঁদ ডুবতে তখনও দু-প্রহর বাকি| কো জাগরতি, কে জেগে আছো? মা লক্ষ্মী যদি ডাক দেন? পুজোর প্যান্ডেলে সবাই রাত জাগছে| অধিকাংশই মহিলা| এই প্রজন্মের নয়| বেশিরভাগেরই চুলে রুপোলি টান, মুখে বলিরেখার আলপনা, কোজাগরীর চাঁদে চোখের আরাম|
এর মধ্যেই পাড়ার মধ্যে সবচেয়ে বর্ষীয়ান আশি ছুঁই ছুঁই বাণী মাসীমা গেয়ে উঠলেন ‘লক্ষ্মী যখন আসবে তখন…’ |কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা সুচিত্রা মিত্রের কিংবদন্তি গায়কীতে নয়| বাউল অঙ্গে| অরূপরতন নাটকে ঠাকুরদা যেভাবে গেয়েছিলেন, সেভাবে| পূর্বা দামের গায়কীতে| কিছুদিন আগেই মেসোমশাই চলে গিয়েছেন| বাণী মাসীমার গাওয়া গানে আধ্যাত্মিক বিরহে আর্তিটা মানবিক হাহাকারে ছড়িয়ে গেল| বাউলাঙ্গের অতলে ডুবে গেল গায়িকার কন্ঠে কোমল রেখাবের পদ্মকুঁড়িটি|
“হল না তার ফুটে ওঠা, কখন ভেঙে পড়ল বোঁটা—
মর্ত্য কাছে স্বর্গ যা চায় সেই মাধুরী কোথা রে পাই,
পদ্মটি নাই, পদ্মটি নাই…|”
সত্যি তো কেবল প্রকৃতিতেই নয়, আমাদের চারপাশের অতল কালো ভেদ করে আমাদের হৃদকমল, পদ্মের সুরভি ছড়িয়ে ফুটে উঠতে পারছে কই? সত্যি তো সে পদ্মটি নাই, পদ্মটি নাই|